গল্প- সাধের বাগান

সাধের বাগান
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

-এ বাবা সকাল সাতটা বেজে গেল। আর তুমি এখনো মেন গেটের তালাটা খোলো নি।
-আজ থেকে ঠিক করেছি নটা পর্যন্ত মেন গেটটা তালা বন্ধ রাখবো।
-সে আবার কি কথা গো? প্রতিমা আসবে না কাজ করতে?
-প্রতিমা তো রোজ নটার পরই কাজে আসে। সুতরাং নয়টায় মেন গেটের তালা খুললে কারোর অসুবিধা হবে না।
-হ্যাঁ গো গেরস্থ ঘরে বেলা নটা পর্যন্ত মেন গেটে তালা ঝুলিয়ে রাখা কি ভালো কথা! কত লোকের টুকিটাকি দরকার পড়ে বলতো।
-কার কার টুকিটাকি দরকার পড়ে বলতে পারবো না। তবে ঘোষ বৌদির তে রোজ এক ঝুড়ি করে ফুলের দরকার পড়ে তা আমি বলতে পারি।
-ধ্যাৎ, কি যে ফালতু বকছো‌। ঘোষ বৌদি কবে আবার এক ঝুড়ি ফুল তুলে নিয়ে গেল?
-গিন্নি তুমি যদি সংসারের চতুর্দিকে খেয়াল রাখতে তাহলে আমাকে আজ নয়টা পর্যন্ত মেন গেটে তালা মেরে রাখতে হতো না।
তপতী চোখগুলো গোল গোল করে বলে, বাঃ বাঃ খুব ভালো বললে তো তুমি। আমি ঘরে থেকে সংসারের চতুর্দিকে খেয়াল রাখি না আর তুমি অফিসে বসে বসে সংসারের খুঁটিনাটি সমস্ত জিনিসের খেয়াল রাখো।
এই যে গত রোববার মিউনিসিপ্যালিটির মজদুরগুলো আমাদের ত্রিশ ধামা বালি নিয়ে সরকারি ড্রেন বানানোর কাজে লাগিয়ে দিল।তা তো আমি খেয়াল করলাম বলেই তুমি বসে একথা জানতে পারলে।
-আহা গিন্নি চটছো কেন? আমি তো তোমার ভালোর জন্যই এখনও পর্যন্ত মেন গেটটা তালা চাবি দিয়ে রেখেছি।
তপতী বিষ্ময়ের সাথে বলে, আমার ভালো? সকাল নটা পর্যন্ত মেন গেট বন্ধ রাখলে আমার কি ভালো হবে একটু বুঝিয়ে বলবে?
সুকান্ত বাবু বেশ বিজ্ঞের মতো বললেন, এই যে আজ এখনও পর্যন্ত গেট বন্ধ আছে। আর সেই কারণেই তুমি দুই ঝুড়ি ফুল তুলতে পারলে বাগান থেকে।
তপতী এতক্ষণে বুঝতে পারলো কেন তার পতি দেবতা সকাল নয়টা পর্যন্ত আজ গেট বন্ধ রেখেছে।
আসলে তপতীদের বাগানটা বড় সুন্দর।লাল, সাদা, হলুদ, গেরুয়া, গোলাপী রঙের জবা গাছের সমাহার বাগান জুড়ে। তাছাড়াও আছে ঠিকরে টগর, চাপ টগর, সাদা নয়নতারা, গোলাপী নয়নতারা, অপরাজিতা এইসব ফুল ফোটে কম বেশি সারা বছর ধরে। আর শীতের দিনে দুই তিন রকমের গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া এইসব দিয়ে দারুণ সুন্দর করে বাগানটাকে সাজিয়ে তোলে সুকান্ত বাবু।
মাঝেমধ্যে আবার বেগুন, ঢেঁড়স, শশা, লঙ্কা, গাজর, টমেটো, ধনেপাতা এইসবও চাষ করেন বেশ। তাছাড়া আছে পেয়ারা গাছ, পেঁপে গাছ, কারিপাতার গাছ, আম গাছ।
সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যে মেন গেট খুলে দিলেই পাড়া প্রতিবেশীরা ফুল তুলতে হাজির হয়ে যায়। পলিথিন ব্যাগ ভর্তি করে ফুল তো তুলবেই তার সঙ্গে টমেটো, বেগুন, কাঁচা লঙ্কা এইসবও টপাটপ তুলে ব্যাগে ভরে নেয়।
সুকান্ত বাবু তো পাড়া প্রতিবেশীদের এইসব কান্ডকারখানা দেখে রেগে যান ভীষণ। রাগে গজগজ করতে করতে ওদের পিছনে বলতে থাকেন, আমি কষ্ট করে বাগান করবো আর পাড়া সুদ্ধ লোক এসে কানমুলে ফুল, সবজি সব তুলে নিয়ে যাবে।
তপতী তখন বুঝিয়ে বলে, আহা রাগ করো কেন এতো? গাছে তো অনেক ফুল ফোটে।তাই তো ওরা তুলতে আসে। আমি যেমন ঈশ্বরের পায়ে ফুল দিয়ে থাকি ওরাই তো তাই করে। ব্যাপারটা কিন্তু একই।
-এইসব কথা শুনে সুকান্ত বাবু আরো রেগে যেতেন। তপতীকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, এতো ভালো মানুষি ভালো না। তোমার আশকারা পেয়েই তো ঘোষ বৌদি গেট খোলা মাত্রই ঢুকে পড়বে বাগানে। আমার তো মনে হয় ভোর থেকেই ও অপেক্ষা করে আমি কখন গেটটা খুলবো।
এই তো গতকাল দেখি জবা ফুটেছে খুব কম। তোমার ঠাকুরের জন্য ভাবলাম আমি আগে গিয়ে ফুলগুলো তুলে রাখি। সাজিটা নিতে ঠাকুর ঘরে ঢুকেছি মাত্র তার মধ্যেই গেট খুলে ঘোষ বৌদি সোজা পৌঁছে গেছে।দশটা জবার তিনটি রেখেছে তোমার জন্য।বল কষ্ট হয় কিনা? ফুল তোলার আগে তো আমাদের কাছে একবার পারমিশন নেওয়া উচিত। কোনো ভদ্রতা বোধ নেই।
তপতী বুঝতে পারে তার পতি দেবতা ঘোষ বৌদির ওপর চটেছে বেজায়। তবু সে বলে, হ্যাঁ গো ঘোষ বৌদির ঘরের ঠাকুর আর আমাদের ঘরের ঠাকুর সে তো এক। তাহলে অহেতুক আমরা বিভেদ কেন সৃষ্টি করছি।
তাছাড়া ঘোষদা মানুষটা কিন্তু খুব উপকারী। মনে আছে তো আমাদের রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষার সময় উনি কত সাহায্য করেছিলেন। ওনারাও রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিত আমিও। এক হিসাবে আমরা কিন্তু গুরু ভাইবোন। আমাদের নিজেদের মধ্যে মন কষাকষি করা একদম উচিত নয়।
সুকান্ত বাবুর যদিও তার গিন্নির উপদেশগুলো মোটেই শুনতে ভালো লাগছিল না। তবুও তিনি বললেন, গিন্নি এই বাগানটা আমার সাধের। কেউ যখন ফুল তুলতে এসে কুঁড়িগুলো কিংবা গাছের কচি ডালগুলো ভেঙে ফেলে তখন আমার খুব কষ্ট হয় সত্যি বলছি গো।
তপতী বলে, বুঝতে পারি গো। তুমি গাছপালাগুলোকে সন্তান স্নেহে বড়ো করো। এবার থেকে তুমি নয়টার সময় মেন গেটের তালা খুলো। আমার কোনো অসুবিধা নেই।

এরপর থেকে প্রতিদিনই তপতী লক্ষ্য করে ঘোষ বৌদিসহ আরো অনেকেই সকাল ছয়টা থেকে গেটের পাশে ঘোরাঘুরি করে কিছুক্ষণ তারপর চলে যায়। তপতীর খুব খারাপ লাগে বিষয়টা। তবু সে তার স্বামীর কথা ভেবেই গেটের তালাটা খোলো না। ঠাকুরের কাছে করজোড়ে বলে, প্রভু আমাদের ক্ষমা করো।পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে এমন ছল চাতুরী করতে হবে কোনোদিন ভাবি নি।

সপ্তাহ খানেক পর একদিন ঘোষদা ও বৌদি এলো সন্ধ্যার দিকে তপতীদের বাড়ি। সুকান্ত বাবু সাত তাড়াতাড়ি করে গেট খুলে আন্তরিক আপ্যায়ন করলেন। তপতী চা পরিবেশন করলো পকোড়া সহ যোগে। ঘোষদা চা খেতে খেতে বললেন, একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি কিন্তু আজ আমরা।
সুকান্ত বাবু তপতীর দিকে একটু তাকিয়ে নিল চট করে। তারপর বলে, কি অনুরোধ ঘোষদা?
-সামনের বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন আমাদের এলাকার রামকৃষ্ণ সংঘ-তে বাঁকুড়ার প্রধান মঠের মহারাজ আসছেন সন্ধ্যার দিকে। ধরুন আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত্রি হয়ে যাবে। তাই সংঘের তরফ থেকে আমাদের সকলের মিলিত অনুরোধ যদি আপনার দোতলায় ওনার থাকার ব্যবস্থা করা যায়।
তপতী তো প্রস্তাবটা শোনা মাত্রই ভাবে গদগদ হয়ে বলে, এতো আমাদের পরম সৌভাগ্য। মহারাজ ওনার পায়ের ধুলো আমাদের বাড়িতে দেবেন। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। আমি মহারাজের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখবো।
যথারীতি বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন রাত আটটা নাগাদ মহারাজ সুকান্ত বাবুর দোতলায় এলেন। রাত্রি সাড়ে নটার মধ্যে রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে উনি শুয়ে পড়লেন। পরের দিন ভোর ছয়টার মধ্যে আবার উঠে পড়লেন। আসলে মঠ মিশনের মহারাজরা বেশ অনুশাসন প্রিয় হয়। ওনারা জানেন জীবন সুস্থ থাকতে গেলে নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে সবার আগে।
যেহেতু বাড়িতে মহারাজ আছেন তাই সুকান্ত বাবু সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যেই মেন গেটের তালা খুলে দেন। তালা খোলার মিনিট পনেরোর মধ্যেই ঘোষ বৌদি ফুল তুলতে চলে আসে বাগানে। বহুদিন বাদে ফুল তুলতে এসে টপাটপ ফুল ছিঁড়ে ব্যাগ ভর্তি করতে থাকে। মনের আনন্দে ফুল তোলার পর ঘোষ বৌদি গেল দোতলায়। মহারাজকে প্রণাম করতে।
মহারাজ খাটে বসে বসে বাগানটা দেখছিলেন আর গুনগুন করে গান গাইছিলেন, ‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে উঠ না ফুটে মন’।
ঘোষ বৌদি দরজার পাশে যে টেবিলটা ছিল তার ওপর ফুলের ব্যাগটা রেখে মহারাজের ঘরে ঢুকলো। মহারাজকে ভক্তি ভরে প্রণাম করে ওনার পদতলে বিছানো সতরঞ্জিতে বসলো। তপতী তখন দোতলাতে ছিল।মহারাজের জন্য চা তৈরি করছিল।
মহারাজ ঘোষ বৌদিকে উদ্দেশ্য করে বলে, মা তুমি ফুল দিয়ে ঠাকুরকে সাজাতে খুব ভালোবাসো, না?
ঘোষ বৌদি ভক্তিতে গদগদ হয়ে বলে, হ্যাঁ মহারাজ। ঠাকুরের সিংহাসনটা ফুলে ভর্তি না হলে মনটা ভালো লাগে না।
মহারাজ এই কথাটা শোনার পর সামান্য হেসে বলে, কিন্তু অন্যের পরিশ্রমের ফুল দিয়ে ঠাকুরের সিংহাসন সাজানো তো ঠিক কথা নয়। এতো ফাঁকিবাজি কাজ। তুমি কতটুকু পরিশ্রম করেছো ঈশ্বরের পায়ে ফুল দেওয়ার জন্য ঈশ্বর তো সেটা দেখতে পাচ্ছে। বাড়িতে যদি বাগান করার জায়গা না থাকে টবে গাছ লাগিয়ে ফুল ফোটাও। তারপর সেই ফুল ভক্তি ভরে ঈশ্বরের পায়ে নিবেদন করো। নাই বা হলো ব্যাগ ভর্তি ফুল। মেহনতের দুচারটে ফুলেই ঈশ্বর খুশি হয়ে তোমাকে অনেক আশীর্বাদ করবেন।

মহারাজের এই কথাগুলো শুনে তপতী মনে মনে বলে, কর্তা রেগে গিয়ে এইসব কথা কতবার বলতে চেয়েছে ঘোষ বৌদিকে। আমিই বারণ করেছি সবসময়। যে সামান্য ফুল তোলা নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে লাভ নেই। কিন্তু ঈশ্বরের কি লীলা মহারাজের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিলেন সেসব কথা।
তারপর থেকে ঘোষ বৌদি আর তেমন ভাবে ফুল তুলতে আসতো না তপতীদের বাগানে।যদি কখনও একান্তই দরকার পড়তো বেলার দিকে এসে তপতীদের ঘর থেকে ফুল চেয়ে নিয়ে যেত।
মহারাজের পায়ের ধুলোতে তপতীদের বাড়িটা যেমন ধন্য হয়ে গেল ঠিক তেমন ভাবেই তপতীর পতিদেবতার সাধের বাগানটা বেঁচে গেল। এখন আর যত্রতত্র ফুলের কুঁড়ি, কচি ডাল পালা এইসব ভেঙে পড়ে থাকতে দেখা যায় না।

Loading

Leave A Comment